পবিত্র হজ্ব মহান ইবাদত

120

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
আল্লাহর ঘরের হজ পালনকারী ব্যক্তিকে সবসময় ঘিরে রাখবে দোয়া, কান্নাকাটি, একান্তে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করার সার্বক্ষণিক পরিবেশ। নিজের বাড়ি থেকে বের হয়ে হজ্বের সব বিধান পালন করা পর্যন্ত তার প্রতিটি পদক্ষেপে ও প্রতিটি চক্করে এগুলোই বারবার আসবে। আর এসব কিছুর জন্যই আবশ্যক হলো রিজিক ও উপার্জন হালাল ও উৎকৃষ্ট হওয়া, অর্থকে পবিত্র করতে হবে, খরচাদি হবে পবিত্র।
আবহমানকাল থেকে মানুষের মনমানসিকতা হলো আপন জীবনে সে কোনো বড় ধরনের বা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের আকাক্সক্ষী হয়। জীবনে পরিবর্তন আনতে সর্বদা সে কোনো টার্নিং পয়েন্ট বা পার্থক্য-রেখার অন্বেষায় লিপ্ত থাকে। যেখানে নিজের অতীত জীবন ও ভবিষ্যতের দুইটি স্বাতন্ত্র্য অবস্থান তৈরি হয়ে ওঠে। এজন্য মানুষ বিচিত্র ও বহুবিধ পরিবর্তনের লক্ষ্যে শীত, বর্ষা কিংবা গ্রীষ্ম ও অন্যান্য কালের অপেক্ষার প্রহর গনে। চলমান নিত্যনৈমিত্তিক ও দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা সে কথার সাক্ষ্য প্রমাণ করে।
অনেক মানুষ আছেন, যারা বিয়ের পর কিংবা ছেলে-সন্তানের মা-বাবা হওয়ার পরে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপনের পর অথবা কোনো চাকরি-কর্মে অংশগ্রহণের পর অথবা বড় কোনো সফলতা অর্জন বা কারও কাছে মুরিদ হওয়ার পর ক্রমে পরিবর্তন হতে থাকেন। নতুবা নিজের মাঝে পরিবর্তনের যোগ্যতা সৃষ্টি করতে পারেন। কারণ জীবনে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বহু ঘটনাপ্রবাহ ও বিভিন্ন কর্মকান্ড অতীত জীবন এবং ভবিষ্যতের মাঝে পার্থক্য ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণী রেখা এঁকে দেয়। যেখান থেকে যে কোনো দিকে জীবনের মোড় পরিবর্তনের সুযোগ থাকে।
বাস্তবে বায়তুল্লাহর হজও অনুরূপভাবে মানুষের ফেলে আসা জীবন ও ভবিষ্যতের মাঝে পার্থক্য বা মূল্যায়ন রেখার ভূমিকা রাখে এবং সংশোধন সংস্কার ও পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজের জীবনের আমূল পরিবর্তনের একটি অবস্থানে নিয়ে আসে। হজের পর থেকে মানুষ নিজের সৎ-শুদ্ধ কিংবা পাপ-পঙ্কিলতাপূর্ণ অতীতের সমাপ্তি টেনে নতুন করে নিজের জীবনকে ঢেলে সাজায়। সে সুবাদে তার প্রতিটি কর্মকান্ডে লাগে নবজীবনের ছোঁয়া।
মক্কা-মদিনা ও আশপাশের যেসব পবিত্র-পুণ্য ভূমিতে পূত-পবিত্র আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দারা অবস্থান করেছেন, সেখানে উপস্থিতি, কাবা প্রাঙ্গণে বায়তুল্লাহর মুখোমুখি অবস্থান ও কায়মনোবাক্যে আল্লাহর সকাশে নিজের ভুলত্র“টি মার্জনা কামনা এবং পূর্বকৃত সব গোনাহের ওপর তওবা করা ও অনুতপ্ত হওয়া, নিজের অক্ষমতার কারণে লজ্জানুভব করা, আগামী দিনগুলোতে পুরোপুরি আনুগত্য ও বন্দেগির প্রতিশ্র“তি-স্বীকৃতি এমন প্রভাব বিস্তারকারী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যে, সব অন্যায়-অনাচার ও পাপ-অপরাধ থেকে সৎকর্ম, সদাচরণ ও উত্তম কার্যকলাপের প্রতি জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। জীবনের প্রাচীনদ্বার বদ্ধ করে সফলতা ও অগ্রতার নবদ্বার উন্মুক্ত করে। বরং বলা উচিত সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তানের মতো নবজীবন লাভ করে। এজন্য রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ্ব করবে এবং তাতে অশ্লীল কোনো কর্মকান্ড ও পাপকার্যে লিপ্ত না হয়, তাহলে সে সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তানের মতো প্রত্যাবর্তন করে।’ অর্থাৎ এক নবজীবন ও নতুন অভিযাত্রা সূচনা করে। যেটি দ্বীন-ধর্ম ও দুনিয়া উভয়ের সার্বিক কল্যাণ, সফলতা ও অগ্রগতিতে পুষ্ট হয়।
বিবিধ অনন্যতায় উদ্ভাসিত এক ইবাদতের নাম হজ। একই সঙ্গে এটি কায়িক ও আর্থিক ইবাদত। হজ শুধু সামর্থ্যবানদের ওপরই ফরজ; নামাজ-রোজার মতো ধনী-গরিব সবার জন্য জরুরি নয় এবং জীবনে একবার সম্পন্ন করা ফরজ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে যে ব্যক্তি (ঈমানদার) কাবাঘরে পৌঁছতে সক্ষম হয় তার ওপর আল্লাহর প্রাপ্য হচ্ছে, সে যেন হজ্ব করে।’ (সূরা আলে ইমরান : ৯৬)।
হজ্ব বিপুল সওয়াব, রহমত, বরকত আর মর্যাদায় পরিপূর্ণ। যার জীবনে একবারও হজ্ব পালন নসিব হয় সে অতি সৌভাগ্যবান। মোমিনের জীবনে হজ্বের চেয়ে মহান আর কোনো ইবাদত নেই। হজ্বের মাধ্যমে মোমিনদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাদের এ আগমন হবেÑ যেন তারা তাদের কল্যাণের স্থানে পৌঁছে।’ (সূরা হজ : ২৮)।
একজন হজ্ব পালনকারী গোনাহমুক্ত নতুন জীবন প্রাপ্ত হয়। তার জীবন পবিত্র হয়ে ওঠে। অতীতের সব গোনাহ মাফ হয়ে যায়। সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে হজ্ব থেকে ফিরে আসেন। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ্ব করল, যৌন সম্পর্কযুক্ত কাজ ও কথা থেকে সংযত থাকল এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাকল, সে তার মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনের মতো পবিত্র হয়ে ফিরে এলো।’ (বোখারি ও মুসলিম)। আর একটি গোনাহমুক্ত কবুল হজ্বের প্রতিদান সরাসরি জান্নাত। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘গোনাহমুক্ত গ্রহণযোগ্য হজের একমাত্র বিনিময় আল্লাহর জান্নাত।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
হজ্ব পালনকারী যখন এহরাম পরে এ মহান ইবাদতে মশগুল হয় তখন তার সম্মানার্থে চারপাশের সৃষ্টিজগৎও অংশগ্রহণ করে। সাহল ইবনে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো মুসলমান এহরাম পরে তালবিয়া পড়তে থাকে, তখন তার ডান ও বামের পাথর, বৃক্ষ, মাটিকণা এমনকি জমিনের উপর প্রান্ত থেকে নিচের সর্বশেষ প্রান্ত পর্যন্ত তালবিয়া পড়তে থাকে।’ (তিরমিজি)। আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তুমি যখন হজ পালনকারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করো, তখন তাকে সালাম দাও এবং মোসাফা করে তার ঘরে প্রবেশ করার আগে তোমার গোনাহ মাফের জন্য দোয়া করতে বলো। কেননা হজ্ব পালনকারী গোনাহমুক্ত হয়ে এসেছে।’ (আহমাদ)।
হজ্ব ও ওমরা পালনকারীরা মহান আল্লাহর মেহমান। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর পথে যুদ্ধে বিজয়ী, হজ্বকারী ও ওমরাকারী আল্লাহর মেহমান বা প্রতিনিধি। আল্লাহ তাদের আহ্বান করেছেন, তারা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। আর তারা তাঁর কাছে চেয়েছেন এবং তিনি তাদের দিয়েছেন।’ (ইবনে মাজাহ)। হজ্বের উদ্দেশে বের হলে প্রতি কদমে নেকি লেখা হয়, গোনাহ মাফ করা হয় এবং তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়া হয়। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তুমি যখন বায়তুল্লাহর উদ্দেশে নিজের ঘর থেকে বের হবে, তোমার বাহনের প্রত্যেকবার মাটিতে পা রাখা এবং পা তোলার বিনিময়ে তোমার জন্য একটি করে নেকি লেখা হবে এবং তোমার গোনাহ মাফ করা হবে।’ (তাবরানি)। শুধু তাই নয়, হজের নিয়তে বেরিয়ে মারা গেলেও হজ্বের সওয়াব হতে থাকে। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজ্বের উদ্দেশে বের হলো, এরপর সে মারা গেল, তার জন্য কেয়ামত পর্যন্ত হজ্বের নেকি লেখা হতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি ওমরার উদ্দেশে বের হয়ে মারা যাবে, তার জন্য কেয়ামত পর্যন্ত ওমরার নেকি লেখা হতে থাকবে।’ (তারগিব ওয়াত-তারহিব)।
হজ্বের অনুপম পালনীয় বিধান দেখে শয়তান হতাশায় পড়ে যায়। উম্মুল মোমিনিন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আরাফাত দিনের চেয়ে বেশিসংখ্যক বান্দাকে অন্য কোনো দিনই আল্লাহ জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন না।’ (মুসলিম)। হযরত তালহা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আরাফাতের দিন (হজ্বের দিন) শয়তানকে সর্বাধিক হীন, পেরেশান, ইতর ও ক্রোধান্বিত দেখা যায়। কারণ এ দিন আল্লাহর সীমাহীন রহমত বর্ষণ ও বান্দার বড় বড় গোনাহ মাফের বিষয়টি শয়তান দেখে থাকে।’ হজ্বে শুধু পরকালীন নয়, ইহকালীন কল্যাণও হাসিল হয়। হজ্ব ও ওমরা পাপ মোচনের পাশাপাশি হজ্বকারী এবং ওমরাকারীর অভাব-অনটনও দূর করে।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা হজ্ব ও ওমরা পরপর করতে থাকো, কেননা তা অভাব ও গোনাহ দূর করে দেয়, যেমন রেত লোহা, সোনা ও রুপার মরিচাকে দূর করে দেয়।’ (তিরমিজি)।
এভাবে অসংখ্য হাদিসে হজ্বের ফজিলত বর্ণিত আছে। তাই সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ পালন না করা বা বিলম্ব করা মোটেও উচিত নয়। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এবং আমাদের আকাবির বুজুর্গানে দ্বীন অনেক কর্মব্যস্ততার মধ্যেও অনেকবার হজ্ব পালন করেছেন। ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) সুদূর কুফা থেকে এসে বহুবার হজ্ব পালন করেছেন। এমন কল্যাণ পেতে বিলম্ব না করে সামর্থ্যবানদের এখনই হজ্বের প্রস্তুতি নেয়া জরুরি।
পবিত্র হজ্ব আল্লাহ তায়ালার একটি বিশেষ বিধান। হজ্ব ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সমর্থ পুরুষ ও নারীর ওপর জীবনে একবার হজ্ব ফরজ। হজ্বের ফরমান জারি করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের মধ্য থেকে যারা এই ঘরে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তারা যেন এ ঘরের হজ্ব সম্পন্ন করে। এটি তাদের ওপর আল্লাহর হক। আর যে ব্যক্তি এ নির্দেশ মেনে চলতে অস্বীকার করবে তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি মুখাপেক্ষী নন।’ (সূরা আলে ইমরান : ৯৭)। শান্তি ও সন্তুষ্টির ধর্ম ইসলাম বিশে^র প্রতিটি মানুষের জন্য হজ্বের মাসগুলো নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হজ্বের মাসসমূহ সুবিদিত-সুপরিচিত। এ সময় যে হজ্ব করার ইচ্ছা করবে সে যেন যৌন সম্ভোগ, অশ্লীল কার্যকলাপ ও ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকে।’ (সূরা বাকারা : ২:১৯৭)। শাওয়াল, জিলক্বদ, জিলহজ্ব ও মহররম এ মাসগুলো যুদ্ধ ও রক্তপাত থেকে বিরত থাকার মাস। পবিত্র কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী বিশ^বাসী যদি এ তিন মাস রক্তপাত ও হানাহানি থেকে বিরত থাকার প্রশিক্ষণ নেয়, তবে বছরের বাকি মাসগুলোও যুদ্ধ ও রক্তপাতমুক্ত থাকা সহজ হবে। শান্তির পায়রা খুঁজে পাবে আপন নীড়। স্বর্গীয় প্রশান্তি উপলব্ধি করবে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে প্রত্যেক আদম সন্তান।
হজ্ব এমন একটি ইবাদত যা মোমিনদের দেহ ও আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে তোলে। সুষ্ঠুভাবে হজ্ব সম্পাদনের পর একজন মোমিন রাসুল (সা.) এর ঘোষণা অনুযায়ী নিজেকে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ ভাবতে থাকে। এ ভাবনা তার হৃদয়ের প্রশান্তিকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ্ব করবে এবং তাতে কোনো অশ্লীলতা ও পাপাচার করবে না, আল্লাহ তায়ালা তাকে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ করে বাড়ি পৌঁছাবেন।’ (বোখারি : ১৫২১; মুসলিম : ১৩৫০)। তিনি আরও বলেছেন, ‘এক ওমরা থেকে অপর ওমরার মধ্যবর্তী সময়ের গোনাহগুলোর কাফফারা। আর কবুল হজের বিনিময় জান্নাত ছাড়া কিছুই নয়।’ (বোখারি : ১৭৭৩;  মুসলিম : ১৩৪৯)।
হজ্ব গোনাহ মাফের সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্যও দূর করে দেয়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পরপর একসঙ্গে হজ্ব ও ওমরা করো। কেননা এ হজ্ব ও ওমরা দারিদ্র্য এবং গোনাহ দূর করে দেয়। যেমন হাপরের আগুন লোহা ও সোনা-রুপার ময়লা দূর করে দেয়।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৫৬৯৮; তিরমিজি : ২৮৮৭)। রাসূল (সা.) এর এ বাণীকে স্বীকার করে নিয়েছেন আজকের বড় অর্থনীতিবিদরাও। অল্প ক’দিন আগে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এক রিপোর্টে হজ্বকে রিসেশন প্রুফ বা অর্থনীতির মন্দারোধক বলে উল্লেখ করেছেন। ইউএনডব্লিউটিও’র মহাব্যবস্থাপক তালিব রিফাই গালফ নিউজকে বলেছেন, বৈশ্বিক মন্দা বিশেষ করে ইউরোপের চলমান অর্থনৈতিক সংকট হজের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি।
হজ্বের মাধ্যমে একজন মুসলমান শান্তি ও সমৃদ্ধির শিক্ষা লাভ করে। হজ্ব পালনের সময় সে কোনোরূপ উচ্চবাচ্য করে না, কারও প্রতি ঘৃণা ও রাগ-বিদ্বেষ প্রকাশ করে না। ‘ক্ষমা’ তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। দেশে ফিরে এর চর্চা অব্যাহত রাখলে তার পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধু, সহকর্মী, সমাজ ও রাষ্ট্র তার দ্বারা উপকৃত হবে। আর  বিশ^ দরবারে তিনি অনুকরণ, অনুসরণ ও অনুপ্রেরণার মডেলে পরিণত হবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহর উদ্দেশে হজ ও ওমরাহ পালন করো।’ ( সূরা বাকারা : ২:১৯৬)। কারণ একজন হাজী তার গন্ডিতে মডেল হয়ে থাকেন। তাই সে যদি নিখুঁতভাবে হজের প্রশিক্ষণ নিয়ে তার ক্ষেত্রে ফিরতে না পারে তা ব্যক্তি-সমাজ উভয়ের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
হজ্ব শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, অমুসলিমদের জন্যও শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। বিদায় হজ্বের ভাষণে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘হে মানুষ শোন! তোমাদের প্রভু এক, পিতা এক। সাবধান! অনারবের ওপর আরবের, আরবের ওপর অনারবের, কালোর ওপর সাদার, সাদার ওপর কালোর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব বা প্রাধান্য নেই তাকওয়া ব্যতীত। (মুসনাদে আহমাদ : ৫/৪১১; আবু দাউদ : ৪/১৩২)। আমাদের মধ্য থেকে যারা হজ্বে যাচ্ছে এবং যাবে তাদেরসহ আমরা যারা হজ্বে যেতে পারছি না আমাদেরও শান্তিময় সমাজ-দেশ ও বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে তৌফিক দান করুন।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক মহাসমাবেশ, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন বর্ণের, ভাষা এবং আকার-আকৃতির মানুষ একই ধরনের পোশাকে সজ্জিত হয়ে একই কেন্দ্রবিন্দুতে সমবেত হন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রগ্রেসিভ পলিসি ইনস্টিটিউটের ‘ট্রেড ফ্যাক্ট অব দ্য উইক’ প্রকাশনায় ২০০৯ সালেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক অনুষ্ঠানের স্বীকৃতি দেয়া হয় হজ্বকে। যদিও হজ্বের উদ্দেশ্যটা বাণিজ্যিক নয়। আল্লাহ প্রেমের চূড়ান্ত উন্মাদনার এই পবিত্র সফরে কোনো পার্থিব চাওয়া-পাওয়া না থাকলেও জাহেলি যুগ থেকে আজ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহাসমাবেশ হিসেবে হজ্বের অবস্থান শীর্ষস্থানে। পৃথিবীর ৩০ লক্ষাধিক হাজীর আধ্যাত্মিক এ সফর প্রাচীনকাল থেকেই আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অন্যতম প্রধান যোগসূত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্রিটেনের বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, হজ্ব ও ওমরা উপলক্ষে জেদ্দার বাদশাহ আবদুল আজিজ বিমানবন্দরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ৩০ লাখেরও বেশি যাত্রী ওঠানামা করে। আরব নিউজের ১ খবরে বলা হয়, হজ ও ওমরা থেকে সৌদি আরবের বার্ষিক আয় এক হাজার ৭০০ কোটি ডলার প্রায়। মক্কা, মদিনা, জেদ্দা এবং তায়েফের অর্থনীতির সিংহভাগই পরিচালিত হয় হজ ও ওমরাকেন্দ্রিক। ‘বিজনেস মনিটর ইন্টারন্যাশনালের’ এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, হজ্বের সময় টুপি, তসবি, স্কার্ফ, জায়নামাজ এবং হিজাবের মতো উপহার সামগ্রী বেচাকেনার পরিমাণ অন্তত ১১০ কোটি ডলার। (দৈনিক প্রথম আলো : ১৪-১০-২০১৩)। প্রশ্ন হলো, হজ্বে সৌদি আরবের অর্থনীতি চাঙ্গা হলেও আমাদের দেশের অর্থনীতিতে তো লস ছাড়া কিছুই নয়। হজ্ব করা মানেই হাজার হাজার কোটি টাকা সৌদি আরবকে দিয়ে দেশটিকে বড়লোক বানিয়ে দিয়ে আসা। আসলেই কি তাই?
ধর্মীয় উৎসবে আবর্তিত বাংলাদেশের অর্থনীতি। রমজানে যেমন যাকাতের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা হাতবদল হয়; তেমনি ঈদের কেনাকাটা, ঈদে বাড়ি যেতে পরিবহন খাতে আয় হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। ঈদের কেনাকাটাসহ সব মিলিয়ে ঈদুল ফিতরে লেনদেন হয় ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অন্যদিকে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির আরেকটি বিশাল জায়গা দখল করে আছে ঈদুল আজহা। কোরবানি ঈদে শুধু গরু-ছাগল কেনাবেচা হয় প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার। ঈদ আর কোরবানির মতো আমাদের অর্থনীতির গতিশীলতায় হজেরও বিরাট ভূমিকা আছে। (অসমাপ্ত)